কলাপাড়ায় দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ।
বিল্লাল হোসেনঃ- কলাপাড়া
|
সময় নিউজ বিডিঃ পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এ ঘর বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নীতিমালা অনুযায়ী ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল, অসহায় দরিদ্র পরিবারকে নির্বাচিত করে বিনা পয়সায় ঘর বরাদ্দ দেওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে অর্থের বিনিময়ে ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। খাস জমি বরাদ্দের ক্ষেত্রেও ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, ষাটোর্ধ্বদের বিবেচনায় নেয়নি টাস্কফোর্স কমিটি। তালিকা থেকে শুরু করে ঘর সম্পন্ন পর্যন্ত দফায় দফায় টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এমনকি একই নামে একাধিক ঘর বরাদ্দের তথ্য রয়েছে তালিকায়। এছাড়া নিম্নমানের উপকরণ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ঘর। ভূমি ও গৃহহীনদের জন্য নীতিমালা-২০২০’র আলোকে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের উপকারভোগীদের নামের তালিকা নির্ভুলভাবে সম্পন্ন করার বিধান থাকলেও তা মানা হয়নি। ৩৯৪ বর্গফুটের ২ কক্ষবিশিষ্ট পাকা/সেমিপাকা ঘরে একটি টয়লেট, একটি রান্নার ও ইউটিলিটি স্পেস গুণগত মানসম্পন্ন উপকরণ সামগ্রী দিয়ে তৈরি করা হয়নি। তালিকাভুক্ত উপকারভোগী ’ক’ শ্রেণি যার জমি ও ঘর কিছুই নেই, ’খ’ শ্রেণি যার এক থেকে ১০ শতাংশ জমির সংস্থান আছে কিন্তু ঘর নেই তার নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ করার কথা। আর যাদের জমি নেই তাদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ খাস জমি বন্দোবস্ত পূর্বক ব্যবহার করার নির্দেশনা রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে ৫ সদস্যবিশিষ্ট উপজেলা কমিটির সভাপতি ইউএনও, সদস্য সহকারী কমিশনার (ভূমি), এলজিইডি প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান এবং সদস্য সচিব পিআইও। ঘর নির্মাণ কাজের অগ্রগতি উপজেলা পরিষদের মাসিক সভায় ও টাস্কফোর্স কমিটির সভায় অবহিতের বিধান থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি ও টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য এলজিইডি উপজেলা প্রকৌশলী মহর আলী বলেন, ঘর-সংক্রান্ত বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমাকে কমিটির সদস্য হিসাবে রাখলেও কোনো মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতে বলা হয়নি। তাই এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য আমার কাছে নেই।’ প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্য সচিব পিআইও হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর-সংক্রান্ত সব ফাইলপত্র ইউএনও স্যারের কাছে। স্যার এটির আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা। আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।’ উপজেলা পরিষদ ভাইস চেয়ারম্যান শফিকুল আলম বাবুল খান বলেন, ভূমিহীন, আশ্রয়হীনদের জন্য উপজেলায় কত ঘর এসেছে জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, এটা আমাদের ব্যাপার। আমার কাছে ঘর এসেছে। এটা আপনি কে জানার? এই জনপ্রতিনিধি আরও বলেন, ‘আমি মহিপুরের একটি দুস্থ পরিবারের জন্য ইউএনওর কাছে সুপারিশ করেছি, কিন্তু দেওয়া হয়নি। ইউএনও কার্যালয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নিয়ে গোপন বৈঠক করে ৪০-৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে ঘর দেওয়া হয়েছে।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘরের নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনে প্রথম ধাপে ৪৫০টি ঘরের বিপরীতে পরিবহণ ও জ্বালানি খরচের ১৮ লাখ ২৫ হাজার এবং দ্বিতীয় ধাপে ১১০টি ঘরের বিপরীতে পরিবহণ ও জ্বালানি খরচের ৫ লাখ ৭০ হাজার টাকাসহ মোট ২৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা লোপাট করা হয়েছে। এছাড়া ৫৬০টি বরাদ্দকৃত ঘরের জন্য প্রতি উপকারভোগীর কাছ থেকে ৩০-৪০ হাজার টাকা হারে প্রায় ২ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। এ বিষেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ধূলাসার ইউনিয়নের তারিকাটা গ্রামের বাদল খান নামের একজন ভুক্তভোগী। লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, ‘ইউএনওর নামে চেয়ারম্যান আবদুল জলিল আকন ও মোস্তাক মেম্বর ঘরপ্রতি ৩৫ হাজার টাকা করে মোট ২৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। এছাড়া ঘর তৈরিতে নিম্নমানের ইট, বালু, সিমেন্ট ব্যবহার করায় ইসমাইল হাওলাদার, বাদল, দুলাল ও রতন মোল্লার ঘর নির্মাণের পর পরই ভেঙ্গে পড়ে। তাৎক্ষণিক যেনতেন করে তা পুনরায় মেরামত করা হয়। বাদল খান আরও বলেন, পশ্চিম ধূলাসার গ্রামের মৃত নাসির গাজীর ছেলে সুমন গাজীকে পশ্চিম চাপলি ও চরচাপলি গ্রামের বাসিন্দা দর্শাইয়াকে একই নামে দুটি ঘর বরাদ্দ দিয়ে চেয়ারম্যান মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন, যা তালিকার ২৭৮ ও ২৯৭ নম্বরে দৃশ্যমান। একই গ্রামের দুলাল হাওলাদারের স্ত্রী আমেনা বেগম (৩২) বলেন, ঘর পেতে দুই কিস্তিতে ২০ হাজার করে মোট ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি। আবদুল ছালাম সিকদারের মা রওশনারা (৫৫) বলেন, ঘর পেতে ৩৪ হাজার টাকা ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জসিম মোল্লার কাছে দিয়েছি। টাকা নেওয়ার সময় টিউবওয়েল ও জায়গা দেওয়ারর কথা ছিল। কিন্তু কিছুই দেয়নি। পচা ইট দিয়ে ঘর করে দিয়েছে। জসিম মোল্লা টাকা নেওয়ার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, চেয়ারম্যান ও মোস্তাক মেম্বর আমাকে ঘরপ্রতি ৩০ হাজার টাকা খরচ বাবদ উত্তোলন করতে বলায় আমি টাকা উঠিয়ে তাদের দিয়েছি। পরে জেনেছি এসব ঘর প্রধানমন্ত্রী এমনিই দিয়েছেন। তবে ধূলাসার ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল আকন ও মোস্তাক মেম্বর এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। লতাচাপলী ইউনিয়নের থঞ্জুপাড়া গ্রামের ভুক্তভোগী আবুবকর খান (৩৮) বলেন, ঘর বরাদ্দ পেতে আমাকে ৩৫-৪০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। মেম্বর হারুন ভদ্র এ টাকা নিয়েছেন। এছাড়া পরিবহণ খরচ, মিস্ত্রিদের মজুরি ও খাওয়া খরচ তো আছেই। এখন আবার শুনছি টয়লেটের মালামাল দেবে না। একই ওয়ার্ডের ইসমাইল (৩২) বলেন, মেম্বরকে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছি ঘর পাওয়ার জন্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঘর পাইনি। জানতে চাইলে মেম্বর হারুন ভদ্র বলেন, আমার ওয়ার্ডে ৩টি ঘর পেয়েছে। এসব ঘরের জন্য কিছু টাকা খরচ বাবদ নেওয়া হয়েছে। তবে তারা যে অঙ্ক বলছে তা সঠিক না। একই ইউনিয়নের মুসুল্লীয়াবাদ গ্রামের নওমুসলিম হাসান খান বলেন, ঘর বরাদ্দ পাওয়ার পর নির্মাণ সামগ্রী পরিবহণ ও অফিস খরচের জন্য লতাচাপলী ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মজিবুর রহমান মুসল্লি ১৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। ৮টি ছাগল বিক্রি করে আমি ১৫ হাজার টাকা দিয়েছি। এরপর ১০ দিন কাজ করে রাজমিস্ত্রি সহকারীর বেতন বাবদ ১০ হাজার টাকা নেয় ঠিকাদার মো. ওয়াদুদ খান। মিস্ত্রিদের দুপুরের খাবার তো আছেই। জানতে চাইলে লতাচাপলী ইউপি চেয়ারম্যান আনছার উদ্দিন মোল্লা বলেন, এসব লেনদেনের বিষয়ে আমার জানা নেই। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) জগৎবন্ধু মণ্ডল বলেন, শুধুমাত্র খাস জমি বরাদ্দের আবেদন যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য সচিব হিসাবে আমি ছিলাম। অন্য কোনো বিষয়ে মন্তব্য করা আমার এখতিয়ারবহির্ভূত। ইউএনও আবু হাসনাত মোহম্মদ শহিদুল হক বলেন, ’এ সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ আমার কাছে আসেনি। তাছাড়া টাকা উত্তোলনের জন্য আমি কাউকে দায়িত্বও দিইনি। যদি কেউ টাকা উত্তোলন করেন তা নিজ দায়িত্বে করেছেন। এজন্য তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা করার পরামর্শ দেন তিনি। পটুয়াখালী জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এ ধরনের অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মাহবুব হোসেন বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের নীতিমালাবহির্ভূতভাবে ঘর বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ নেই। যদি কেউ নীতিমালাবহির্ভূতভাবে ঘর বরাদ্দ দেন তিনি বিপদে পড়বেন। |