ভাসানচরে স্বস্তিতে প্রথম মাস
|
সময় নিউজ বিডিঃ মিয়ানমারের রাখাইন থেকে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার প্রায় সাড়ে তিন বছর হতে চলেছে। ঠিক কবে, কখন মিয়ানমারের নিপীড়িত জনগোষ্ঠী তাদের আদি নিবাসে ফিরতে শুরু করবে, সেটা একপ্রকার অনিশ্চিত। এমন এক প্রেক্ষাপটে ঠিক এক মাস আগে কক্সবাজারের শিবিরের ওপর চাপ কমাতে ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে সরকার ভাসানচরে সরিয়ে নেয়। ভাসানচরে যাওয়া রোহিঙ্গা নারী-পুরুষেরা বলছেন, তাঁরা সেখানে নতুন এক জীবনের স্বাদ পেয়েছেন। রাখাইনের আদি নিবাসে ফেরার আগে তাঁরা থেকে যেতে চাইছেন বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা নোয়াখালীর নতুন চরটিতে। এক মাস আগে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলটিকে সরিয়ে নেওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলে জাতিসংঘ। এর পরপরই শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা স্থানান্তরের পুরো প্রক্রিয়াই স্থগিত করার আহ্বান জানায়। অবশ্য পরে সরকার দ্বিতীয় দফায় ডিসেম্বরের শেষে আরও ১ হাজার ৮০৪ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করে। দুবারই স্থানান্তরের সময় রোহিঙ্গাদের সফরসঙ্গী হিসেবে গণমাধ্যমের একদল কর্মী ভাসানচরে গেছেন। এই প্রতিবেদক দুই দফায় ভাসানচর গিয়ে বিভিন্ন বয়সের রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুদের সঙ্গে কথা বলেছেন। অধিকাংশ রোহিঙ্গার কণ্ঠেই ছিল ভাসানচর নিয়ে স্বস্তির কথা। তাঁরা বলেছেন, জীবন ও জীবিকার যে প্রতিশ্রুতি শুনে ভাসানচরে এসেছেন, তার বাস্তবায়ন চান। ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা এবং কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, মাসখানেক আগেও রোহিঙ্গাদের সরানোর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোভাব যতটা কঠোর ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অবস্থান কিছুটা নমনীয় হয়েছে। ভাসানচরে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে নেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল রোববার তাঁর দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও গণমাধ্যমকে পর্যায়ক্রমে ভাসানচরে নিয়ে যাব। মিয়ানমারের মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লিকে এরই মধ্যে আমরা ভাসানচরে নিয়ে গেছি। ভবিষ্যতেও আমরা জাতিসংঘকে ভাসানচরে নিয়ে যাব।’ দুই দফায় ভাসানচরে নেওয়া ৩ হাজার ৪৪৬ জন রোহিঙ্গার মধ্যে শিশু ১ হাজার ৬৫৮, নারী ৯৮৭ এবং পুরুষ ৮০১ জন। আশ্রয়ণ-৩ প্রকল্প নামে পরিচিত ভাসানচর প্রকল্পের প্রধান আবদুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় বলেন, ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের জীবন ও জীবিকা স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছে। গত শনিবারও রোহিঙ্গাদের জন্য আরও ৫০ টন খাবার এসেছে। এখন পর্যন্ত যে পরিস্থিতি তাতে আশা করা যায়, জাতিসংঘ এবং কূটনীতিক মিশনের প্রতিনিধিরা ভাসানচর সফরে গিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখাবেন। গত ৩০ ডিসেম্বর দুপুরে ভাসানচরে কথা হয় উখিয়ার কুতুপালংয়ের শিবির থেকে আসা হামিদা বেগমের সঙ্গে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, চারপাশের সবকিছু মিলিয়ে তিনি কক্সবাজারের চেয়ে ভাসানচরে ভালো আছেন। সরকার তাঁদের প্রতিটি পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ও রসদ সরবরাহ করেছে। হামিদার আবাসস্থল থেকে বেরিয়ে পথের ধারে জড়ো হয়ে থাকা নুর হোসেন, দিল মোহাম্মদ আর নুরুল কালামের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা সবাই ভাসানচরে নিরাপদ আর স্বস্তিতে থাকার কথা জানালেন। অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-জ্জোহা গতকাল বিকেলে বলেন, কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নেওয়া পর্যন্ত আরআরআরসির দপ্তর নৌবাহিনী, এনজিওবিষয়ক ব্যুরো, জেলা প্রশাসন ও এনজিওদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করেছে। এখন পর্যন্ত ভাসানচরে কাজ করছে ৩০টি এনজিও। প্রতিটি পরিবারের জন্য খাবারসহ সব ধরনের মানবিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন সেখানে ভালো আছেন। তবে জীবন আর জীবিকা নিয়ে তাঁরা অনেক কিছু চান। সরকারের একার পক্ষে তাঁদের সব চাহিদা পূরণ করা সম্ভব কি না সেই প্রশ্নটা থেকে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট অনেকেই শিশুদের শিক্ষার বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলছেন। কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আর্থসামাজিক ঝুঁকির পাশাপাশি নিরাপত্তার ঝুঁকি উপেক্ষা করেও বাংলাদেশ লাখ দশেক রোহিঙ্গার ভার কাঁধে নিয়েছে। কাজেই এ বিষয়টিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখে জাতিসংঘকে কিছুটা ছাড় দেওয়া উচিত। তেমনি সরকারেরও এটা বিবেচনায় নিতে হবে, কক্সবাজারের মতো ভাসানচরেও জাতিসংঘকে যুক্ত রেখে মানবিক সহায়তা দেওয়াটা জরুরি। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে সরকারের নিজের অর্থায়নে রোহিঙ্গাদের সহায়তা দেওয়াটা সম্ভব কি না, সে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে। |