অপহরণ গুম খুন যেন নিত্যসঙ্গী
|
সাধারণ রোহিঙ্গাদের জন্য দিনকে দিন অনিরা বসবাসের ৩৪টি ক্যাম্প। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, ইয়াবা ব্যবসা, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঘটছে খুনাখুনির ঘটনা। অপহরণ, গুম ও হত্যাও যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। তিন বছরেই গ্রুপিংয়ের বলি হয়েছে শতাধিক রোহিঙ্গা। আর গুম হয়েছে অর্ধশত। তাই সাধারণ রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে ও ঝামেলা এড়াতে ভাসানচরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে দলে দলে বাংলাদেশে আসতে থাকে রোহিঙ্গারা। মানবিক কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় দেন। বর্তমানে ৩৪টি ক্যাম্পে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তবে কিছু দুষ্কৃতকারীর কারণে সাধারণ রোহিঙ্গারা অনিরাপদ হয়ে পড়েছে বলে জানালেন উখিয়ার কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের চেয়ারম্যান হাফেজ মওলানা জালাল আহমদ। তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালের আগে আমরা খুব ভালো অবস্থায় ছিলাম এখানে। নতুন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অনেক খারাপ মানুষও এসেছে। তাদের কারণে আজ আমরা চরম অনিরাপদ হয়ে গেছি। অপহরণ, গুম, খুন আর মাদকব্যবসাও বেড়ে গেছে।’লম্বাশিয়া ক্যাম্পে বসবাসকারী বয়োবৃদ্ধ রোহিঙ্গা আব্দুল করিম বলেন, ‘শুধু কিছু সন্ত্রাসী নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশের জন্য গত দুই সপ্তাহে আটটি তাজা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। আমরা এসব সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সমর্থন করি না। তাই নিরাপদ থাকার জন্য ভাসানচরে যেতে চাই।’ ময়নারঘোনা ক্যাম্পের রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে প্রাণের ভয় নিয়ে থাকার চেয়ে ভাসানচরে গিয়ে নিরাপদভাবে বসবাস করলে অনেক ভালো হবে।’ জামতলী ক্যাম্পের আবুল কাশেম, ফরিদুল আলম, করিমা বেগম, রহিমা খাতুন ও মাবিয়া বেগম জানান, দুই সপ্তাহ ধরে তারা ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। পরিবারের সবাইকে নিয়ে খুব আতঙ্কের মধ্যেই দিন কাটাতে হচ্ছে। অনেকেই ক্যাম্পের বাইরে চলে গেছে প্রাণ বাঁচাতে। তারাও ভাসানচরে চলে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। চাকমারকুল ক্যাম্পে বসবাসকারী মোহাম্মদ কাশেম, ফয়েজ, নূর হোসেন ও রাবিয়া বসরি জানান, রোহিঙ্গাদের মধ্যে কিছু মানুষ রক্তপিপাসু হয়ে উঠেছে। মা-বোনদেরও ইজ্জত লুটছে তারা। এই রোহিঙ্গারা বলেন- যেহেতু আপাতত মিয়ানমার যেতে পারছি না, সেহেতু প্রাথমিকভাবে আমরা ভাসানচরে চলে যেতে চাই। পরিস্থিতি ভালো হলে সেখান থেকেই আমরা নিজ দেশ মিয়ানমারের ফিরে যাব। বালুখালী ক্যাম্পে বসবাসকারী রোহিঙ্গা সলিমুল্লাহ, মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ও শামসুল আলম বলেন, যে বাংলাদেশ আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, আমাদের খাদ্য দিচ্ছে, সে দেশের মানুষকে এ জানোয়াররা ক্যাম্পে অপহরণ করে এনে হত্যা করছে। এটা আমাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার। আমাদের রোহিঙ্গাদের কিছু বিপথগামী সদস্য ক্যাম্পের ভেতর বসা বাজারগুলো থেকে চাঁদা উঠানো থেকে শুরু করে নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। অনেকেই এখানে ভিতর থেকে ইয়াবা ব্যবসাও করছে, যা আমরা চাই না। তাই আমাদের মতো সাধারণ রোহিঙ্গাদের জন্য এ ক্যাম্পগুলো দিন দিন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। অন্তত একটু শান্তিতে বসবাস করার জন্য হলেও আমরা ভাসানচরে চলে যেতে চাই। শফিউল্লাহ কাটা ক্যাম্পের বয়োবৃদ্ধ মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, ‘আমাদের কিছু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী পথভ্রষ্ট হয়ে নিজেদের মানুষকেই অপহরণ ও জিম্মি করে টাকা আদায় করছে। এমনকি গ্রাম থেকেও লোকজনকে ধরে এনে মুক্তিপণ আদায় করছে। জড়িয়ে পড়েছে মাদকব্যবসায়। বিভিন্ন হাটবাজার থেকে চাঁদা আদায় করছে। যেসব জুলুম-অত্যাচারের জন্য আমরা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছি, আমাদের লোকজনই এখন সেগুলো করছে আমাদের ওপর। এটা খুবই লজ্জাজনক। তাই এসব বিপথগামীর হাত থেকে নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতে আমরা প্রয়োজনে ভাসানচরে যেতে রাজি।’ একই কথা বলেন শফিউল্লাহ কাটা ক্যাম্পের আফজাল হোসেন ও ফরিদুল আলম। হাসিনা বেগম, মোহাম্মদ শাহেদ, রহিমুল্লাহ ও ফজলুল হক থাকেন চাকমারকুল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মধ্যেও বেশ আতঙ্ক। বললেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের আশ্রয় না দিলে আমরা হয়তো প্রাণটাই বাঁচাতে পারতাম না। কিন্তু এদেশে আসার পর কিছু রোহিঙ্গা এখন স্থানীয়দের ওপর হামলা করছে। এতে আমরা খুব বিব্রতবোধ করছি। ইয়াবাব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়েছে অনেকে। নিজেদের মা-বোনদেরই এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে ধরে নিয়ে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। তবে ৯৯ ভাগ রোহিঙ্গাই এগুলোকে সমর্থন করে না। নিজেদের রক্ষায় বেশিরভাগই এখন ভাসানচরে চলে যেতে চাই। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, ২০১৭ সালে নানা অপরাধে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ছিল ৭৬টি। আসামি হয় ১৫৯ জন। ২০১৮ সালে ২৩৮ মামলায় আসামি হয়েছে ৪১৪ জন। ২০১৯ সালে মামলার সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২৬৩টি। আর আসামি হয় ৬৪৯ জন। চলতি বছরের এ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ২০৪টি মামলা হয়েছে। আসামির সংখ্যা ৭০৫ জন। যদিও সামাজিক বিরোধ, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ যে কোনো ধরনের অপরাধ প্রবণতা দমনে ক্যাম্পগুলোতে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে অন্য স্থানে যেতে না পারে সেজন্য চেকপোস্টগুলোকে আরও সক্রিয় করা হচ্ছে। এর পরও উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে সম্প্রতি নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে এক বাংলাদেশিসহ আটজন নিহত হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনা হবে। পুলিশ ইতোমধ্যে ক্যাম্প এলাকা থেকে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত ২৫ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন।’ এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার শামসুদ্দোজা নয়ন বলেন, ‘ক্যাম্পের পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে। আমরা সব সময় তা পর্যবেক্ষণ করছি।এদিকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার অফিস জানায়, ভাসানচরে বর্তমানে ৩০৬ রোহিঙ্গা বসবাস করছে। সেখানে তাদের জন্য কী কী সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা দেখানোর জন্য গত ৫ সেপ্টেম্বর দুজন সিআইসিসহ ৪০ রোহিঙ্গার একটি প্রতিনিধি দল সেখানে যায়। ভাসানচর পর্যবেক্ষণ শেষে তারা সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, বসবাসের জন্য স্থানটি খুবই উপযোগী। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা পরে কক্সবাজার ক্যাম্পের অন্য রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করেছেন। তাই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য বর্তমানে ভাসানচরে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা ভাসানচরে যেতে আগ্রহী হলে তাদের অবশ্যই সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’ With Regards, Tanvir Ahme |