প্রাণঘাতী ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, অ্যালকোহল ও হেরোইনের।
|
সময় নিউজ বিডিঃ প্রাণঘাতী ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, অ্যালকোহল ও হেরোইনের দখলে দেশের মাদকের বাজার। সর্বনাশা এ দ্রব্যগুলো পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে যেমন আসছে, তেমনিভাবে দেশেও সমানতালে ভেজাল দিয়ে তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন অপদ্রব্যের সংমিশ্রণে অলি-গলিতে এগুলো তৈরি হয়। সেবনের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মাথায় রেখেই এতে ভেজাল মেশানো হয়। এগুলো দেখতেও প্রায় একই রকম, দামও কম। সহজলভ্যতার কারণে সেবনকারীও প্রচুর। বাস্তবে এগুলো আসলের চেয়েও ভয়ংকর। একইসঙ্গে মাদক ও ভেজাল দুই ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে সেবনকারীরা। মাদক এবং ভেজাল বিষ-এ দুইয়ের ভয়াল থাবা এক হয়ে কেড়ে নিচ্ছে মানুষের জীবন।
মাদকদ্রব্য উদ্ধারকারী সংস্থাগুলোর দেয়া তথ্যমতে, দেশে এখন অন্তত ২৫ ধরনের মাদক রয়েছে। এর মধ্যে এক সময় ফেনসিডিলই ছিল প্রধান। ইয়াবা আসার পর এর ব্যবহার কিছুটা কমেছে। দেশের মাদক সেবনকারীর বড় অংশই এখন ইয়াবায় আসক্ত। সহজলভ্য হওয়ায় গাঁজা সেবনকারীর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য। আমদানি নিষিদ্ধ বিদেশি মদের বাজারও রমরমা। হেরোইন অল্প পরিমাণে এলেও এর সেবনকারীর সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। দেশে বহুল প্রচলিত এ পাঁচ মাদকের বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় যুগান্তর। এতে মাদকের ভয়াল থাবার ভয়ংকর সব চিত্র উঠে এসেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক ড. দুলাল কৃষ্ণ সাহা যুগান্তরকে বলেন, দেশে যে এখন কত রকমের মাদক আছে তা বলে শেষ করা যাবে না। তবে আসলের চেয়েও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেজাল মাদক। দেশের প্রচলিত মাদকের প্রায় সবই বিভিন্ন অপদ্রব্য দিয়ে ভেজাল তৈরি হচ্ছে। যা খেয়ে প্রচুর প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। মানুষের অজ্ঞতা, অসচেতনতার ফলে এই অবস্থার তৈরি হয়েছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে চাহিদাও বাড়ছে। এ সুযোগে অলি-গলিতে রাস্তায় তৈরি এসব দ্রব্য মানুষ গ্রহণ করছে। এ অবস্থা বন্ধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। জানা যায়, মাদকদ্রব্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভেজাল মেশানো হচ্ছে ইয়াবায়। বিশ্বের কোথাও ইয়াবার কোনো রেজিস্ট্রার্ড ফর্মুলা নেই। ফলে যে যেভাবে খুশি সেভাবেই এটি তৈরি করছে। এটা এমফিটামিন জাতীয় ড্রাগ। তৈরির মূল উপাদান সিউডোফেড্রিন। রয়েছে ইফেড্রিনের ব্যবহারও। বিক্রিয়া ঘটিয়ে এটা ট্যাবলেট তৈরি হয়। যা গ্রহণ করলে কিডনি, লিভার ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নষ্ট হয় যৌন ক্ষমতা। বাড়ে রক্তচাপ ও হ্রাস পায় সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা। সংশ্লিষ্টরা জানান, এক কেজি সিউডোফেড্রিনের দাম মাত্র চার হাজার টাকা। এ পরিমাণ সিউডোফেড্রিন দিয়ে অন্তত এক লাখ ইয়াবা তৈরি করা যায়। যার মূল্য প্রায় দুই থেকে তিন কোটি টাকা। ফলে লোভে পড়ে অনেকেই এটি তৈরি করছেন। আর চাহিদা থাকায় তৈরি হচ্ছে প্রচুর। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভেজাল ইয়াবা তৈরিতে মেয়াদোত্তীর্ণ প্যারাসিটামল, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, টেক্সটাইলের রং ব্যবহার হয়। এছাড়া পেইনকিলার, মসুরের ডাল, চক পাউডার, ট্যালকম পাউডার, গ্লুকোজ, বিশেষ ধরনের মোম কেমিক্যাল, ভ্যানিলা পাউডারও ব্যবহার হয়ে থাকে। অবস্থাটা এমন যে, ক্রেতাকে বোঝানো গেলেই হয় এটা ইয়াবা। তাহলেই বিক্রি হবে। ভেজাল ইয়াবা তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক যুগান্তরকে বলেন, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় আমরা একটা কারখানা পেয়েছিলাম। যেখানে দেখেছি ট্যাবলেট বানানোর খাঁজ বা ফর্মা আছে। এতে কাঁচামাল দিয়ে হাতে চাপ দিলেই ট্যাবলেট হয়ে যায়। আরেকটা বানানো যায় অটোমেটেড মেশিনে। এরকম মেশিন বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ও হোমিপ্যাথিক ফার্মেসিতেও থাকে। কারণ তারাও এ ধরনের ট্যাবলেট করে। মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন ওষুধ ভেজাল ইয়াবায় ব্যবহারের ফলে এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে।’ এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘সম্প্রতি অ্যালবিয়ন নামের একটি ট্যাবলেট ধরা পড়ে নওগাঁয়। যা দেখতে হুবহু ইয়াবার মতো। এতে অ্যামিট্রিফাইলাইন থাকে। যাদের একটু পাগল টাইপের মানসিকতা হয় তাদের এ ওষুধটা খাওয়ায়। এটাকে ইয়াবা বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। ইয়াবা যেহেতু গোপনে বিক্রি হয় তাই আর সেভাবে যাচাই-বাছাইও হয় না। সম্প্রতি সবচেয়ে ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেজাল অ্যালকোহল। দেশে গত কয়েকদিনে ভেজাল মদ খেয়ে অন্তত ৩৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আসল মদ অতিরিক্ত সেবনের ফলে প্রতিবন্ধী হওয়া, লিভার সিরোসিস, কর্মক্ষমতা হারানোসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। সেখানে ভেজাল মেশানো মদ সেবনে ‘মৃত্যু ডেকে আনা’ বলছেন বিশেজ্ঞরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মদ তৈরি হয় ইথাইল অ্যালকোহল বা রেক্টিফাইড স্পিরিট দিয়ে। এটি খাওয়া যায়। অবৈধগুলো মেথিলেটেড স্পিরিট দিয়ে তৈরি। এগুলো খেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। এর সঙ্গে থাকে বিভিন্ন রং, কেমিক্যাল, কোমল পানীয়সহ বিভিন্ন অপদ্রব্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেথিলেটেড স্পিরিট ১৫-১৬ মিলি লিটার, মানে বড় এক চামচ খেলে চোখ অন্ধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। লিভার-কিডনি ড্যামেজ হয়ে যায়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সম্প্রতি বগুড়া, ঢাকা ও গাজীপুরে যারা মারা গেছেন তারা মেথিলেটেড স্পিরিট খেয়েছেন। এক লিটার মিথাইল অ্যালকোহলের দাম ৫০ টাকা। ইথাইল অ্যালকোহলের দাম সাড়ে চারশ’ থেকে ৫০০ টাকা। ভাঙারির দোকানিরা যেসব বোতল বিক্রি করে রাস্তাঘাটে সেগুলোতে ভরে তৈরি হয় এ মদ। তারা ভাবে যেহেতু চাহিদা আছে সাপ্লাই হবেই। ওরা ভেজাল মিশিয়ে এগুলো তৈরি করে বোতলে ভরার পরে মোম দিয়ে মুখটা আটকে দেয়। নরসিংদী ও গাইবান্ধাতে মৃত্যুর ঘটনাও নকল মদের কারণেই হয়েছে। তাই রাস্তা-ঘাটে যেখানে-সেখানে মদ পেলেই খাওয়া যাবে না।’ তিনি বলেন, ভালো মদ খেয়ে যদি কেউ ট্রাংকুলাইজার বা ঘুমের ওষুধ খায়, তাহলেও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে যে কেউ মারা যেতে পারে। দামি মাদক হেরোইন এখন অন্যতম ভয়ের কারণ। যা সেবনে লিভার সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ, তীব্র কোষ্ঠকাঠিন্য, কিডনি রোগ, হার্ট ও ত্বকে সমস্যা, হেপাটাইটিস, নারীদের সন্তান জন্মদানে অক্ষমতা, গর্ভপাত হতে পারে। দেশে উদ্ধার হওয়া এই হেরোইনেও পাওয়া গেছে মারাত্মক ভেজাল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমাদের দেশে যে হেরোইন পাওয়া যায় সেখানে ৩-৫ ভাগ হেরোইন থাকে। বাকিটা অপদ্রব্য থাকে। খাঁটি হেরোইন হলো সাদা। এর ১ কেজির দামই ৩৫ কোটি টাকা। যা যুক্তরাষ্ট্রে বেশি হয়। এশিয়া জোনে হেরোইনের পিউরিটি একেবারেই কম। দেশে অনেক সময় ব্রাউন হেরোইনও উদ্ধারের ঘটনা আছে। এগুলো মূল হেরোইনের সঙ্গে তামাকজাত গুল ও চক পাউডার দিয়ে তৈরি হয়। মাদক উদ্ধার সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, দেখা গেল ১০০ গ্রাম হেরোইন এনে আর ১০০ গ্রাম গুল মিশিয়ে দিল। অথবা মূল হেরোইনের সঙ্গে চকপাউডার বা এ জাতীয় কিছু দিয়ে দিল। এতে তাদের দ্বিগুণ লাভ। কারণ বর্ডার এলাকায় ২-৩ লাখ টাকা এর কেজি। যা ঢাকায় এলে ১০ লাখ টাকা হয়ে যায়। সেজন্য তারা এতে ভেজাল মেশাচ্ছে। এক সময়ের প্রধান মাদক ফেনসিডিলেও পাওয়া গেছে ভেজাল। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক যুগান্তরকে বলেন, কোডিন ফসফেট দিয়ে তৈরি হয় বেশিরভাগ ফেনসিডিল। আর এর বোতল, কর্ক চানখাঁরপুলেও বস্তায় বস্তায় পাওয়া যায়। ফেনসিডিল ভারতে ৩৭৫ টাকা আর ঢাকায় আড়াই হাজার টাকাতেও বিক্রি হয়। অবৈধ ব্যবসায়ীরা এ লোভ ছাড়তে পারে না। ১০টা ফেনসিডিল এনে কফের সিরাপ, ঘুমের ওষুধ, ব্যথার ওষুধ মিশিয়ে ২০-৩০টা বানায়। এতে ভেজালের কোনো শেষ নেই। এ মাদকে মেয়েদের থেকে ছেলেদের বেশি ক্ষতি হয়। এর বাইরে গাঁজাতেও বিভিন্ন রকমের ভেজাল মেশায় মাদক ব্যবসায়ীরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাঁজা মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি করে, স্মৃতিশক্তির সমস্যা হয়, রক্তবাহী শিরায় ক্ষতির কারণে রক্ত পরিবহণে সমস্যা করে, স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করে, ঝুঁকিতে পড়ে চোখের দৃষ্টি। এর বাইরে পুরুষের টেস্টিকুলার ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কথা হয় কয়েকজন গাঁজা সেবনকারীর সঙ্গে। তারা জানান, বিভিন্ন সময়ে গাঁজার বদলে অন্য লতা-গুল্ম পেঁচিয়ে গাঁজা হিসাবে চালিয়ে দেয়া হয়। যেহেতু এটা গোপনে বিক্রি হয় তাই বিক্রি করেই মাদক কারবারিরা সটকে পড়ে। |