বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলা শাখার আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে সৃষ্ট বির্তক গত দুই বছরেও শেষ হয়নি। বরং কমিটির কার্যক্রম নিয়ে জেলা ও কেন্দ্রের ভুমিকা নিয়েও প্রশ্নের উদ্রেক সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ মেয়াদ উত্তীর্ণ দুইটি ইউনিয়ন কমিটি ভেঙ্গে আহ্বায়ক কমিটি গঠন নিয়ে বিতর্ক নতুন করে চাঙ্গা হয়েছে। এসবের সাথে যুক্ত রয়েছে আওয়ামী লীগের দলীয় গ্রুপিং।
জানা গেছে, গঠনতন্ত্র মোতাবেক বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সম্মেলন করে নতুন কমিটি গঠন করার নিয়ম থাকলেও চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের বিগত তিনটি কমিটি গঠন নিয়ে এর ব্যতয় ঘটেছে। জেলা কমিটিকে পাশ কাটিয়ে যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ পর পর তিনটি কমিটি অনুমোদন দেয়। এগুলো হলো: ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারী আলমগীর হোসেন রিপনকে আহ্বায়ক, বিল্লাল হোসেন পাটওয়ারীকে , হাজী সফিকুর রহমান যুগ্মআহ্বায়ক করে প্রথম কমিটি, ২০১৭ সালের ১০ এপ্রিল বিল্লাল হোসেন পাটওয়ারীকে আহ্বায়ক, হাজী সফিকুর রহমান ও মহিউদ্দিন ভূইয়া ইরানকে যুগ্মআহ্বায়ক ২য় কমিটি এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আবু সুফিয়ান শাহীনকে আহ্বায়ক ও হেলাল উদ্দিনকে যুগ্মআহ্বায়ক করে তৃতীয় কমিটি। কেন্দ্র থেকে প্রেরিত কমিটি বলে জেলা যুবলীগ কমিটি মেনে নিতে বাধ্য হলেও সর্বশেষ দুইটি কমিটি নিয়ে বির্তকের সৃষ্ট হয়।
দলীয় সূত্র জানায়, বিল্লাল হোসেন পাটওয়ারী, হাজী সফিকুর রহমান ও মহিউদ্দিন ভূইয়া ইরানকে যুগ্মআহ্বায়ক করে দেয়া উপজেলা যুবলীগের কমিটি তাদের দায়িত্ব বুঝে পেয়ে পর্যায়ে ক্রমে পৌর কমিটিসহ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন কমিটি গঠন সম্মেলনের মাধ্যমে সম্পন্ন করে। এসব কমিটি গঠনের সময়ে সাবেক এমপি ড. মোঃ শামছুল হক ভুঁইয়া ও চাঁদপুর জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান কালু ভুঁইয়া ও সিনিয়র যুগ্মআহব্বায়ক সালাউদ্দিন বাবরসহ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। ইউনিয়ন কমিটি সম্মেলন শেষে উপজেলা যুবলীগের সম্মেলন করার জন্য জেলা যুবলীগের কাছে সম্মেলন করার অনুমতি ও তারিখ চেয়ে আবেদন করলে, জেলা যুবলীগ ২০১৯ সালের ২৫ অক্টোবর ফরিদগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করে।
এরই মধ্যে যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ এর স্বাক্ষরিত ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আবু সুফিয়ান শাহীনকে আহ্বায়ক ও হেলাল উদ্দিনকে যুগ্মআহ্বায়ক করে তৃতীয় কমিটির চলে আসে। যদিও এই কমিটিকে স্ক্যানিং করা কমিটি বলে অভিহিত করছে যুবলীগের নেতৃবৃন্দ। ফলে এটি বৈধ নয় বলে তারা জানায়।
অন্যদিকে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ে টালমাটাল অবস্থা ও ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা হওয়ায় জেলা কমিটি ২৩ অক্টোবরের সম্মেলন স্থগিত করে। এরপর অদ্যবদি তা আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে আবু সুফিয়ান শাহীনের নেতৃত্বাধীন আহ্বায়ক কমিটি প্রথমে জেলা কমিটি মেনে না নিলেও পরবর্তীতে জেলা যুবলীগ আহ্বায়ক মিজানুর রহমান কালু ভূঁইয়া তাদের সকল কর্মসুচীতে অংশ গ্রহণ করে তাদের মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত দেন।
বিগত ফরিদগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামীলীগ দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে যুবলীগের দুইটি কমিটিই তাদের প্রচারনা করেছে। এর মধ্যে হাজী সফিকুর রহমান ও মহিউদ্দিন ভূইয়া ইরানের কমিটির সাথে যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক টিম তসলিম উদ্দিন এর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল পৌর নিবার্চনের প্রচারণায় অংশ গ্রহণ করে।
অন্যদিকে জেলা যুবীলগের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান কালু ভূইয়ার নেতৃত্ব জেলা যুবলীগের একটি অংশ আবু সুফিয়ান শাহীনের নেতৃত্বাধীন কমিটির সাথে নির্বাচন প্রচারণা অংশ নেন।
সর্বশেষ গত ২৭ মে আবু সুফিয়ান শাহীনের নেতৃত্বাধীন উপজেলা যুবলীগের বিশেষ সভায় মেয়াদ উত্তীর্ণ দুটি কমিটি বিলুপ্ত ও নতুন আহ্বায়ক কমিটি দেয়া নিয়ে আবারো প্রকাশ্যে দ্বন্ধের বিষয়টি সামনে চলে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব বিষয় ভাইরাল হয়।
উপজেলা যুবলীগের কমিটিসহ সাম্প্রতিক সমস্যাদি নিয়ে যুবলীগের যুগ্মআহ্বায়ক মহিউদ্দিন ভূঁইয়া ইরান গত ৩০ মে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের পেইজ থেকে ৮টি কারণ ও তথ্য উল্লেখ করেন। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করলে তিনি আশা করছেন সকল সমস্যার সমাধান হবে।
তিনি তার পেইজে লিখেন, ‘যুবলীগের বিষয়ে কেন্দ্র এবং জেলাকে একাধিকবার সমস্যা সমাধানে পত্র দিয়ে অবহিত করেছি। ফরিদগঞ্জ উপজেলায় একটি স্ক্যানিং কমিটির আবির্ভাব হয়েছে সেটাও কেন্দ্র এবং জেলাকে বারবার অবহিত করেছি যা যা কেন্দ্র এবং জেলার কাছে প্রেরিত পত্রের ৮ ও ৯ নং কলামের স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে।
গত ২০১৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখের যুবলীগের স্ক্যানিং কমিটি হওয়ার কারণে কমিটির কাগজ সাদাকালো অথচ চাঁদপুর জেলার সকল উপজেলা সহ বাংলাদেশের সকল জেলা ও উপজেলায় কেন্দ্রের কালার প্যাডে কমিটি দেওয়া হয়েছে। স্ক্যানিং কমিটির পদধারীরা আজও কালার প্যাডের কমিটি দেখাতে পারে নাই।
স্ক্যানিং কমিটির খবর পাওয়ার পর আমরা জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান কালু ভূঁইয়ার কাছে গিয়ে বিষয়টি অবহিত করি। তিনি আমাদেরকে অবহিত করেন যে ‘এরকম সাদাকালো স্ক্যানিং করা কমিটির কাগজ নিয়ে এসেছিল আমি তাদেরকে বলেছি কেন্দ্রের কালার প্যাডের কমিটি নিয়ে এসো। তিনি আমাদেরকে বলেন তোমাদেরকে যেহেতু সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেছি তোমরা সম্মেলনের প্রস্তুতি নাও, ফরিদগঞ্জে সম্মেলন হবে এর বিকল্প কিছু নাই কিন্তু পরবর্তীতে কোন অদৃশ্য শক্তির বলে তিনি সেই স্ক্যানিং কমিটি গ্রহণ করে অথচ জেলা যুবলীগের আহবায়ক ব্যতীত বৃহৎ অংশ আমাদের কমিটি বৈধ বলে আমাদেরকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথারীতি নির্দেশনা প্রদান করেন।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মাইনুল ইসলাম নিখিল এর কাছে ফরিদগঞ্জ উপজেলা যুবলীগ এবং বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রায় ৫০ জন নেতৃবৃন্দ দেখা করার পর , তিনি উপজেলা ও ইউনিয়ন এর সকল কাগজপত্র দেখানো হয় তিনি কাগজ পত্রাদি পর্যালোচনা করে আমাদের উপজেলা কমিটি বৈধ বলে মন্তব্য করেন এবং জেলা যুবলীগের কাছে বর্ধিত সভার তারিখ চেয়ে পত্র দেওয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন।
ফরিদগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় যুবলীগের নির্বাচন পরিচালনা সমন্বয় কমিটির কুমিল্লা অঞ্চলের প্রধান যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য তসলিম উদ্দিন ভাইয়ের পথসভা ফরিদগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়।
এসব বিষয়ে কথা বললে উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান শাহীন জানান, কেন্দ্রীয় কমিটি ও জেলা কমিটির নিদের্শনা মেনে আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের অনুষ্ঠানে বর্তমান এমপি মুহম্মদ শফিকুর রহমান নিয়মিত অংশ গ্রহণ করেন। পুরো উপজেলা যুবলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের নেতৃত্বে নতুন করে সুসংঠিত হয়েছে। দুইটি ইউনিয়ন কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় এবং তাদের কার্যক্রম না থাকায় আমরা সেগুলো বিলুপ্ত করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি দিয়েছি।
অন্যদিকে যুবলীগের আহ্বায়ক (ভারপ্রাপ্ত) হাজী সফিকুর রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় নিদের্শনা মোতাবেক আমরা উপজেলা সম্মেলনের তারিখের অপেক্ষায় রয়েছি। সম্মেলনের মাধ্যমে যদি নতুন কেউ আসে তাতে আমাদের আপত্তি নেই। তাছাড়া স্ক্যানিং করা কমিটি বিষয়ে আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান নিখিলসহ সাংগঠনিক টিমের সাথে লিখিত ও মৌখিক ভাবে কথা বলেছি। আশা করছি দ্রুততম সময়ে সমাধান আসবে। যুবলীগ দ্বন্দ্বের অবসান চাই আমরা। তাছাড়া ইউনিয়ন কমিটি বিলুপ্ত করার এখতিয়ার নেই স্ক্যানিং কমিটির।
তিনি আরো বলেন, আমি ব্যক্তিগত ভাবে কোন রূপ সংঘাতে জড়িত হতে চাই বিধায়। এখন পর্যন্ত নিজেদের অবস্থানে থেকে দলীয় কর্মসূচী পালন করে চলেছি। তাছাড়া যাদের সাথে লড়বো সেই স্ক্যানিং কমিটির আহ্বায়ক ছাড়া বাকীরাও আমাদের দলের লোক। তাছাড়া আমি সারাজীবন পদ ধরে রাখবো সেই ধারায় বিশ্বাসী নই। তবে সবকিছু নিয়মতান্ত্রিক পক্রিয়া চলা উচিত। যেভাবে গত দুই বছর ধরে যুবলীগের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তা দু:খজনক। আমি কেন্দ্রীয় চেয়ারম্যান, সাধারণ সম্পাদক , সাংগঠনিক টিম এবং জেলা নেতৃবৃন্দের কাছে দ্রুত আমাদেরকে উপজেলা সম্মেলনের মাধ্যমে আমাদের কাজটুকু শেষ করতে সহযোগিতা করতে দাবী জানাচ্ছি।
চাঁদপুর জেলা যুবলীগের যুগ্মআহ্বায়ক ও দপ্তর সম্পাদক ঝন্টু দাস জানান, বিগত তিনটি কমিটিই কেন্দ্র থেকে পাঠানো। সর্বশেষ দেওয়া কমিটি নিয়ে বির্তক দেখা দেয়ায় আমরা ওই সময়ে কেন্দ্রে যোগাযোগ করলেও যুবলীগের পরিস্থিতি তথা সাবেক চেয়ারম্যান কোন সন্ধান না থাকায় সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদের সাথে কথা বলি। তিনি আমাদের কমিটি বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন নি। এই বিষয়ে দপ্তর সম্পাদক জানান। কিন্তু যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক আনিছুর রহমান নানা ঘটনায় আত্মগোপন করলে আমরা এই বিষয়ে আর কিছু জানতে পারি নি।
তিনি বলেন, ফরিদগঞ্জ উপজেলা যুবলীগ নিয়ে আমরা নিজেরাও বিব্রত। যুবলীগের উপজেলা কমিটি ও সাম্প্রতিক ইউনিয়ন কমিটি নিয়ে সৃষ্ট বির্তক নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি ও সাংগঠনিক টিমের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। আশা করছি দ্রুত একটি সমাধান চলে আসবে।
জেলা যুবলীগের সালাউদ্দিন বাবর জানান, ইতিপুর্বে যুবলীগের কমিটি নিয়ে আমরা কেন্দ্রে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সেখান থেকে ওই সময়ে কোন সাড়া না পাওয়ায় আমরা বিগত কমিটির মতো এটিকেও কার্যক্রম চালাতে বলি। কেন্দ্র থেকে ঘোষিত চিঠি অনুযায়ী ওয়ার্ড কমিটি গঠন ছাড়া ইউনিয়ন কমিটি বাতিল ও নতুন করে করতে পারে না , বিধায় আমরা বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তা জানিয়ে দেই।
কিন্তু সর্বশেষ ইউনিয়ন কমিটি নিয়ে সৃষ্ট বির্তক ও উপজেলা যুবলীগের কমিটি নিয়ে সম্প্রতি কেন্দ্র সাংগঠনিক টিমের সাথে যোগাযোগ হয়েছে । আশা করছি দ্রুত একটি সমাধান খুঁজে পাবো।