কলাপাড়ার ম্যারাডোনা খ্যাত রাখাইন ফুটবলার লাভামং।।
মোয়াজ্জেম হোসেন কলাপাড়া(পটুয়াখালী)।।
|
সময় নিউজ বিডিঃ প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের লীলাভূমি সাগরকন্যা খ্যাত পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলা। খেলাধূলার পাশাপাশি কুয়াকাটা, পায়রা সমুদ্র বন্দর সহ বিভিন্ন স্থাপনার কারণে বাংলাদেশের সুপরিচিত উপজেলা এটি। এ উপজেলার ম্যারাডোনা খ্যাত রাখাইন সম্প্রদায়ের প্রাক্তন ফুটবলার লাভা মং। ফুটবল ছিল তার ধ্যান ও জ্ঞান।
এই প্রজন্মের অনেকেই জানেন তার ফুলবল কৃতির কাহিনী। এক সময় কলাপাড়ার ফুটবল মানেই ছিল লাভা, মোচা, মোসিও, থমুসে, ধলুসে। এরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। পরিবার থেকেই ফুটবল খেলার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি। লাভার জন্ম ১৯৫৫ সালে কলাপাড়ায়। কলাপাড়া পৌর শহরের বর্তমান গোডাউন ঘাট সংলগ্ন ০৬ নং ওয়ার্ডের পৈতৃক বাড়িতে। ব্যক্তিগত জীবনে বিয়ে করেননি তিনি। বাবার অসুস্থতা সাংসারিক অভাব অনটন এবং দূরে থাকা সব মিলিয়ে ফুটবলের প্রতি অগাধ ভালোবাসার কারণেই সংসার করা হয়নি এ সুপারস্টারের।
একান্ত সাক্ষাৎকারে লাভামং জানিয়েছেন, স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২ সালে খেপুপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। ওই বছর আমাদের বিদ্যালয় পটুয়াখালী জেলায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে খুলনা বিভাগীয় পর্যায়ে খেলতে যায়। সেই টিমের নেতৃত্ব দিয়েছিলাম আমি সহ আমার ছোট ভাই মোচা, দেলোয়ার, মোফাজ্জেল এবং মনু। পরবর্তীতে ১৯৭৬ সালে ঢাকা গিয়ে বি,পি,ডব্লিউ,ডি প্রথম বিভাগ ফুটবল দলে আমি এবং আমার ছোট ভাই মোচা যোগদান করি। সেখানে কৃতিত্বের সাথে সাইট ব্যাগ খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি। ১৯৭৭ সালে প্রয়াত ছোট ভাই মোচা জাতীয় (লাল) দলে চান্স পায়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অবসরে কলাপাড়া এসে হাইস্কুল মাঠে খেলতে গিয়ে মোচার পা ভেঙ্গে গেলে জাতীয় দলে আর খেলা হয়নি তার। সে সুস্থ হলে আবার ঢাকা গিয়ে আরামবাগ ক্রীড়াচক্রে দুই ভাই যোগ দেই। পায়ের সমস্যার কারণে দুই বছর পরে মোচা চলে আসলে পরবর্তী বছর পরে পরিবার এবং এলাকার টানে কলাপাড়া চলে আসি। কিছুদিন এলাকায় ফুটবল খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছেন চার ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই চিনথাও ঢাকা ফায়ার সার্ভিস একাদশের হয়ে এক বছর খেলেছেন। এছাড়াও ছোট দুই ভাই থমুসে এবং ধলুসে এলাকার হয়ে ফুটবল খেলেছেন। মোট কথা ফুটবল ছিল আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। তিনি আরও জানিয়েছেন ১৯৭৭ সালে বি,পি,ডব্লিউ,ডি বনাম ঢাকা মোহামেডান ক্লাবের মধ্যকার উত্তেজনা পূর্ণ ম্যাচে আমার নৈপুণ্যের কারণে ২-২ গোলে ড্র হয়েছিল। এবং সেই ম্যাচের কারনেই দলে নিয়মিত হয়ে গিয়েছিলাম। আগে ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা দলের সাপোর্ট করতাম। এখন মনে হচ্ছে ছোট দলগুলোও ভালো পারফরম্যান্স করছে। প্রিয় খেলোয়াড় আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনা এবং ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার রোনালদো। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন’র শের-ই বাংলা জাতীয় ফুটবল টূর্ণামেন্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে তিনি জানিয়েছেন। তিনি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, এক সময়ের জনপ্রিয় কলাপাড়ার ঐতিহ্য ফুটবল রাজনৈতিক কারণে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌছেছে। ফুটবল খেলোয়াড়দের মানোন্নয়নে ঢাকা থেকে কোচ এনে চার মাস অনুশীলন করানো প্রয়োজন বলে তিনি জানিয়েছেন।
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ছোট ভাই মোচার হার্টের সমস্যা ধরা পরার কারণে সেও বিবাহ করেননি। অবশেষে ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে স্ট্রোক করে মারা যান মোচা। সর্বশেষ ২০২১ সালে মা মারা গেলে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন লাভা। আর্থিক টানা পোড়ন চলছে। কিন্তু ফুটবল তার মন থেকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারেননি।
খ্যাতিমান এ ফুটবলারকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় গোল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট-২০২১ সন্মাননা স্মারক ক্রেস্ট প্রদান করা হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রীড়া সংস্থা কলাপাড়া উপজেলা শাখার পক্ষ থেকে এ সন্মাননা পুরস্কার প্রদান করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সভাপতি আবু হাসনাত মো.শহীদুল হক। কলাপাড়া পৌরসভার মেয়র বিপুল চন্দ্র হাওলাদার, সাবেক মেয়র হাজী হুমায়ুন সিকদার, সাবেক ব্যাবসায়ী সমিতির সভাপতি নুরুল হক মুন্সি, ব্যাবসায়ী ইউসুফ মিয়া সহ তার সহপাঠীরা কলাপাড়া উপজেলায় স্ব-স্ব ভাবে প্রতিষ্ঠিত। তারা সকলেই এই ক্রীড়াবিদের মঙ্গল কামনা করেন।
নীলগঞ্জ ইউপির নবীপুর গ্রামের সাবেক ফুটবলার আবুল বাসার জানান, লাভা দাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তিনি একজন কোমল মনের মানুষ। একসাথে খেলেছি, অনেক ব্যাপারে তার পরামর্শ নিতাম। তিনি আরও জানান, সাবেক এই সুপারস্টার কলাপাড়া বাসীর মনে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন।
কলাপাড়া প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহসিন পারভেজ জানান, অর্থের প্রতি কখনো লোভ ছিলনা তার। সেই আমলে ঢাকার ক্লাব থেকে বারো হাজার টাকা সন্মানি পেত তিনি। লাভা ও তার প্রায়াত ছোট ভাই মোসা যেদিন কলাপাড়া স্কুলের হয়ে কলেজের বিরুদ্ধে টুর্নামেন্ট খেলত সেদিন স্কুল মাঠে খেলা দেখতে দর্শকদের উপচে পড়া ভীড় থাকতো। এই আদিবাসী তুখোড় খেলোয়াড়ের জন্য আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করে যাতে একটু সচ্ছল জীবন যাপন করতে পারে তার জন্য উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার কাছে দাবি জানান তিনি।
লালুয়া ইউপি চেয়ারম্যান শওকত হোসেন তপন বিশ্বাস জানান, লাভা আমার কাছের বন্ধু এবং সহপাঠী। আমার নির্বাচনী ইউনিয়ন লালুয়ায় তার গ্রামের বাড়ি। পারিবারিক ভাবেই তার সাথে আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো। তিনি আরও জানান, স্কুলজীবন থেকেই ফুটবলের প্রতি প্রবল আকর্ষণ ছিল তার পুরো পরিবারের।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু হাসানাত মো.শহীদুল হক জানান, ঢাকা আরামবাগ ক্রীড়া চক্রের সাবেক এই কৃতি খেলোয়াড় এবং কলাপাড়ার ফুটবলাঙ্গনের গৌরব লাভা মং কে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্মাননা প্রদান করার সুযোগ পেয়ে গৌরবান্বিত বোধ করছি। তার দীর্ঘায়ু এবং সুস্থ জীবন কামনা করেন তিনি।
|