শরীয়তপুরের ‘ইতালি’ গ্রামে দুশ্চিন্তার ছায়া!
|
সময় নিউজ বিডিঃ শরীয়তপুরের নলতা গ্রামের ঘরে ঘরে ইতালিপ্রবাসী। পুরো জেলাতেই করোনাকালে অনেকে কাজ হারিয়েছেন, কারও আয় কমেছে। রিজিয়া বেগমের বয়স আশির বেশি। তাঁর চার ছেলের মধ্যে তিন ছেলে সপরিবার প্রবাসী। গত জানুয়ারিতে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে, এরপর থেকে প্রবাসী ছেলেদের নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন তিনি।রিজিয়ার বাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নলতা গ্রামে। ২৮ নভেম্বর দুপুরে রিজিয়া বেগমের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, তিনি মলিন মুখে ঘরের দরজার সিঁড়িতে বসে আছেন। হাতে স্মার্টফোন। অপেক্ষা, কখন ছেলেরা ফোন করবেন। চার দশক আগে নলতা গ্রাম থেকে ইতালিতে গিয়েছিলেন রিজিয়া বেগমের বড় ছেলে লোকমান খান। ছোট ছেলে দুলাল খানও ইতালিতে ছিলেন। বছরখানেক আগে দেশে ফিরে এসেছেন। এখন সপরিবার ঢাকায় থাকছেন। আরও দুই ছেলে থাকেন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে। স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে রিজিয়া থাকেন গ্রামের বাড়িতে। বললেন, ‘ছেলেরাও আমার জন্য দুশ্চিন্তা করে। আমি বলি, বাবা তোমরা সাবধান থাকো। দুশ্চিন্তা করো না।’ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার নলতা গ্রাম নড়িয়া উপজেলা থেকে পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে ভূমখারা ইউনিয়নের নলতা গ্রাম। গ্রামটি ওই এলাকার অনেকের কাছে পরিচিত ‘ইতালি’ গ্রাম হিসেবে। এই গ্রামে পরিবার আছে সাড়ে পাঁচ শর মতো। প্রত্যেক পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য ইতালিপ্রবাসী। পুরো পরিবার নিয়েও অনেকে আছেন ইতালিতে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে সারা বিশ্বে যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে, সেই ঢেউয়ের ছাপ পড়েছে নলতা গ্রামেও। ইতালির রোম শহরের একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন আবু বক্কর (৪৮)। গত ২৫ নভেম্বর তিনি তিন মাসের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিলেন। ২৮ নভেম্বর তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়নি। বাবা জইন উদ্দিন বললেন, ‘ছেলেটা বিদেশোত থাকায় বাড়ির সবাই দুশ্চিন্তায় ছিলাম।’ ইউপি সদস্য কুদ্দুস দরজির ছেলেও ইতালি আছেন। তিনি বললেন, করোনাভাইরাসের কারণে গ্রামের প্রতিটি পরিবার এখন মনমরা। গ্রামের সবাই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন। এই গ্রামের পাশের গ্রাম নিতিরা। সেখানকার আবদুর রাজ্জাকের বয়স ৫৫ বছর। তিনি ১৯৯৮ সাল থেকে সপরিবার ইতালিতে থাকেন। গত বছর তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দেশে আসেন। ফেরার কথা ছিল গত মার্চে। তিনি বলেন, এর মধ্যে ইতালি ফেরার কথা ছিল। কিন্তু এক মাস আগে জ্বর-সর্দিতে আক্রান্ত হয়েছেন। তাই ইতালিতে থাকা দুই ছেলে, মেয়ে-মেয়েজামাই ফিরতে নিষেধ করেছেন। একই গ্রামের আবদুল মান্নান ফকিরের বড় ছেলে মজনু মিয়া থাকেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। ছোট ছেলে রানা মিয়া থাকেন ইতালিতে। তিনি আপাতত বেকার। তার ওপর কিছুদিন আগে জ্বর হয়েছিল। দুশ্চিন্তায় পুরো পরিবার।
করোনায় হারানো স্বজনের শোক শরীয়তপুর জেলার অভিবাসন–সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার অন্তত ২৫ জন করোনাকালে প্রবাসে মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে ১২ জন ইতালিপ্রবাসী। বাকিরা ফ্রান্স, জাপান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবপ্রবাসী ছিলেন। নড়িয়া উপজেলার ভূমখারা ইউনিয়নের দক্ষিণ চাকধ গ্রামের ইউপি সদস্য জান শরীফের মেয়েজামাই ফরহাদ হোসেন ইতালিতে করোনায় মারা গেছেন ৫ নভেম্বর। মেয়ে জোসনা বেগম দুই ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে থাকছেন ঢাকার মিরপুরে। জান শরীফ বলেন, পরিবারটি অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়েছে। তিনি নড়িয়া থেকে খোঁজখবর নিচ্ছেন। মহিষখোলা গ্রামের সৌদিপ্রবাসী খলিল ব্যাপারী (৪৫) জেদ্দায় মাছ ধরতেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি করোনা-আক্রান্ত হয়ে মারা যান। দাফনও হয়েছে সেখানে। ছোট দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে দিশেহারা স্ত্রী তানিয়া আক্তার। সন্তানদের নিয়ে এখন বাবার বাড়িতে থাকছেন। ২৭ বছরের সীমা আক্তারও হঠাৎ ঘোর অন্ধকারে পড়েছেন। দুই মেয়েকে নিয়ে তিনি থাকতেন স্বামীর বাড়ি শরীয়তপুর সদরের পূর্ব কোটপাড়া গ্রামে। স্বামী শাহ আলম ইলেকট্রনিক মিস্ত্রির কাজ করতেন সৌদি আরবে। সেখানে গত ১৬ মে তিনি করোনায় মারা যান। সীমা বলেন, ‘স্বামীর জায়গাজমি আছে। কিন্তু সেগুলোও দেখাশোনা করার লোক নেই।’ বিদেশে স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি সহায়তার জন্য ফরিদপুর কর্মসংস্থান ও জনশক্তি কার্যালয়ে আবেদন করেছেন। বিদেশফেরতরা ভালো নেই
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর শরীয়তপুরের কার্যক্রম দেখে ফরিদপুর অফিস। তাদের হিসাব বলছে, ২০০৪ থেকে ২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত শরীয়তপুর থেকে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার মানুষ বিভিন্ন দেশে গেছেন। কিন্তু করোনাকালে কত প্রবাসী দেশে ফিরেছেন? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি তালিকা পেয়েছে জেলা পুলিশ। তাদের তথ্য বলছে, গত মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত জেলার অন্তত ২৪ হাজার প্রবাসী দেশে ফিরেছেন। তবে পুলিশ ও অভিবাসন–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনার কারণে শরীয়তপুরে ফিরেছেন, এমন প্রবাসীর সংখ্যা ১০ হাজারের কিছু বেশি হবে। অনেকে শরীয়তপুর জেলার হলেও দেখা গেছে, ঢাকায় ছিলেন। কেউ কেউ হোম কোয়ারেন্টিনের ভয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলেন।
|