জাপা ” এক রোখা” নীতিতে নড়বড়ে।
জান্নাতুল ফেরদৌসঃ- ঢাকা।
|
সময় নিউজ বিডিঃ- দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে ‘একদেশদর্শী নীতিতে’ অটল ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। রওশন এরশাদ, সাদ এরশাদ, মশিউর রহমান রাঙ্গাসহ দলের হেভিওয়েট অনেককে মনোনয়ন দেয়নি জাপা। এতে দলের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। নির্বাচনে মনোনয়ন দিয়ে কারও খোঁজখবর না নেওয়ায় বনানীতে দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের সামনে নির্বাচনের দিন বিক্ষোভ করেন অনেকে। বিক্ষোভকারীরা দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের পদত্যাগও দাবি করেন। নির্বাচনে বড় ধরনের ভরাডুবি ঘটে দলটির। এর আগেপরে নানা ইস্যুতে দল থেকে অনেক নেতাকর্মীকে নিজের ক্ষমতাবলে বহিষ্কার ও অব্যাহতি দিয়েছেন জিএম কাদের। এর মধ্যে গত ২৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে দলের ৬৭১ জন নেতা পদত্যাগ করেছেন। এ অবস্থায় ন্যূনতম আসন নিয়ে দলটি জাতীয় সংসদে যাচ্ছে। তবে দলটি ভেতরে ভেতরে নড়বড়ে হয়ে গেছে বলে খোদ দলের ভেতরেই আলোচনা আছে। অভিযোগ আছে, দলে নিজের লোককে ঠাঁই দেওয়ার জন্য ত্যাগী নেতাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদেরকে চারটি পদ দিয়ে বঞ্চিত করা হয়েছে অন্যদের। সমঝোতার আসন পেয়ে ঢাকা-১৮ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হওয়া শেরীফা কাদেরকে ফের জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে আনার চেষ্টা করছে। এমন বাস্তবতায় দলের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দলটির দুই শীর্ষ নেতার একরোখা সিদ্ধান্তে গত দ্বাদশ নির্বাচনে ভরাডুবি হয়েছে। এখন ব্যক্তিগত স্বার্থে দলটাকে ফের ভাঙনের মুখে ফেলা হয়েছে। তবে কোনো কিছুকেই আমলে নিচ্ছেন না জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের। তিনি দলের গঠনতান্ত্রিক সিদ্ধান্তে কঠোর রয়েছেন বলে জানা গেছে। এদিকে আজ রবিবার বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়া নেতাদের ডেকে কথা বলবেন এবং নিজের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেবেন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রওশন এরশাদ দলের বহিষ্কৃতদের কাছে নিয়ে দলের পরবর্তী সম্মেলনের দিকে এগোবেন। গতকাল শনিবার রওশন এরশাদের মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশীদ স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য নেতৃত্ব ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে অভিভাবকহীন হয়ে পড়া জাতীয় পার্টির তৃণমূল নেতাকর্মীদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন রওশন এরশাদ। দলীয় প্রার্থী ও তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তিনি। এতে দলের শীর্ষনেতারাও অংশ নেবেন। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জিএম কাদের আমাদের সময়কে বলেন, ‘এক দলে দ্ইু কথা থাকতে পারে না। অনেকে জাতীয় পার্টি করে; কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো করে কথা বলেন। এটা কোনো পদ্ধতি হতে পারে না। এসব আগে ছিল বলেই দল নড়বড়ে ছিল। এখন আল্লাহর রহমতে দল অনেক শক্তিশালী। কেউ যেন দলের গঠনতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ড করতে না পারে, সেজন্য দল কঠোর হয়েছে। এটা অব্যাহত থাকবে। এখানে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এতে যদি দল ভেঙে যায় যাক, কিছু যায়-আসে না।’ রওশন এরশাদ আজ রবিবার দলের বহিষ্কৃৃত নেতাদের ডেকেছেন এ বিষয়ে জিএম কাদের বলেন, ‘উনি বয়স্ক মানুষ। অসুস্থ। ওনার এই অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলাচ্ছে। অনেকে লিখিত বক্তব্য এনে তার সামনে দেন। তিনি নিজেও জানেন না কী পড়ছেন।’ জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাও দল থেকে বহিষ্কৃৃত। জাপার বর্তমান কার্যক্রমের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে রাঙ্গা আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমি রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের দুজনের সময় মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেছি। দুজনকে একসঙ্গে এনে বসিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমি চাই ঐক্য। যারা ব্যক্তিগত স্বার্থে দলকে ভাঙার চেষ্টা করছেন, তাদের বলি পল্লীবন্ধুর দলটাকে ভাঙবেন না। আপনারা বেশি দিন বাঁচবেন না। সময় সন্নিকটে। দোহাই আপনাদের, দলে ঐক্য ফিরিয়ে আনুন।’ গত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রওশন এরশাদ দলের বিরোধীদলীয় নেতা হন। পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে তাকে সরিয়ে জিএম কাদের আসার জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু শেষ অবধি তা বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর থেকে দ্বন্দ্ব অব্যাহত আছে। পরে রওশন থাইল্যান্ড চিকিৎসারত অবস্থায় দলটির সম্মেলনের ডাক দেন। এ নিয়ে রওশন ও জিএম কাদের দফায় দফায় বক্তব্য দেন। একপর্যায়ে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে একমঞ্চে উঠলেও দলে ঐক্য ফেরেনি। এই দ্বন্দ্বের জেরে দলীয় মনোনয়ন পছন্দ না হওয়ায় দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে রওশন এরশাদ অংশ নেননি। জানতে চাইলে দলের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, ‘সাদের আসনে জিএম কাদের নিজে মনোনয়ন নিলেন, মশিউর রহমান রাঙ্গাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে মনোনয়ন না দিয়ে রওশনকে ক্ষ্যাপানো হয়। জিএম কাদের চেয়েছিলেন এ রকম আচরণ করলে তিনি নিজে নির্বাচনে আসবেন না। পরবর্তী সময়ে তাই হয়েছে। এখন জিএম কাদের সংসদে বিরোধী দলের নেতা হবেন এই রাস্তা পরিষ্কার করেছেন। সংসদের সংরক্ষিত আসনে থাকবেন তার স্ত্রীও। শুধু থাকবেন না রওশন। সুতরাং রওশনের নেতৃত্বে বিকল্প প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবেই। দলে ভাঙনও হতে পারে।’ এরশাদের জাতীয় পার্টিতে প্রথম বড় ধরনের ভাঙন ধরে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বের হয়ে আলাদা জাতীয় পার্টি ঘোষণা করলে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠনের সময় জাতীয় পার্টি প্রথমে তাদের সমর্থন দিলেও পরে চারদলীয় জোটে চলে যায়। সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এরশাদের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টি নামে নতুন দল গঠন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন ধরে। নাজিউর রহমান মঞ্জু জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের অংশ হয়ে নির্বাচনে যায়। বর্তমানে এই অংশের নেতৃত্বে আছেন আন্দালিব রহমান। এই অংশটির ভেতরও আরেকটি ভাঙন আছে। মন্ত্রিত্ব নিয়ে ঝামেলার একপর্যায়ে এমএ মতিন আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন। এক-এগারোর সময়ও জাতীয় পার্টি দুটি অংশে বিভক্ত হয়েছিল, পরে অবশ্য এ দুটি অংশই এরশাদের নেতৃত্বে এক হয়ে যায়। সর্বশেষ এরশাদের জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ধরান তার পুরানো রাজনৈতিক সহকর্মী কাজী জাফর আহমেদ। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে কাজী জাফর এরশাদকে ছেড়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করে যোগ দেন বিএনপি জোটে। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে দলের বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন জাতীয় পার্টির ঘোষণা দেন কাজী জাফর। একই সঙ্গে তিনি এরশাদকে বহিষ্কারেরও ঘোষণা দেন। সর্বশেষ বিদিশা জাতীয় পার্টি পুনর্গঠন নামে একটি দল গঠন করেন। যদিও দলটির সে অর্থে কার্যক্রম নেই। |